মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

জনসেবায় ডাক বিভাগের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্ব ডাক দিবসের পটভূমি ও ইতিহাস ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর—সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ২২টি দেশ একত্রিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ)—বিশ্বের ডাক ব্যবস্থাকে ঐক্যবদ্ধ করার এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ।
পরবর্তীতে জাতিসংঘ এটিকে তার একটি বিশেষ সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৬৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইউপিইউ কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়— সেই থেকে প্রতিবছর ৯ অক্টোবর উদযাপিত হয়ে আসছে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে।
আজ বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশ এই দিনটি পালন করে ডাক ব্যবস্থার ইতিহাস, অগ্রগতি ও জনসেবায় এর অবদান স্মরণে নানা আয়োজনে।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য
জনগণের জন্য ডাক: স্থানীয় সেবা, বৈশ্বিক পরিসর।
এই প্রতিপাদ্যের মূল বার্তা— ডাক কেবল চিঠি বা পার্সেল পরিবহনের মাধ্যম নয়; এটি মানুষে মানুষে সংযোগ, অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং সামাজিক সহমর্মিতার এক অমূল্য সেতুবন্ধন।
ডাক আজ মানবিক যোগাযোগের প্রতীক—যা সময়, প্রযুক্তি ও প্রজন্মের ব্যবধান পেরিয়ে মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।
বাংলাদেশের ডাক বিভাগের ঐতিহ্য
বাংলাদেশের ডাক ব্যবস্থার সূচনা ব্রিটিশ আমল থেকেই। তবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ডাক বিভাগ নতুন প্রাণ ফিরে পায়।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে একসময় ডাকঘর ছিল যোগাযোগ, সঞ্চয় ও আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। মানি অর্ডার, সঞ্চয় ব্যাংক, পোস্টাল বীমা ও টেলিগ্রাম—এসব সেবা ছিল এক গৌরবময় যুগের স্মারক।
বর্তমানে ডাক বিভাগ ডিজিটাল রূপান্তরের ধারায় এনেছে ই-কমার্স ডাকসেবা, ই-পোস্ট, ডিজিটাল মানি অর্ডার (ইএমও), নগদ সেবা এবং অনলাইন ট্র্যাকিং সুবিধা, যা ডাক ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, দ্রুত ও সময়োপযোগী করে তুলেছে।
ডাক বিভাগের আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাল রূপান্তর
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সরকার ডাক বিভাগকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্য নিয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
(বিডিপোস্ট প্ল্যাটফর্ম) এখন দেশের সর্বত্র পার্সেল প্রেরণ ও ডেলিভারি সেবা দিচ্ছে।
“নগদ” মোবাইল আর্থিক সেবা ডাক বিভাগের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ডাকঘরগুলো এখন কেবল ডাকবিনিময়ের কেন্দ্র নয়—বরং তথ্য, আর্থিক ও প্রযুক্তি সেবার গ্রামীণ হাব হিসেবে কাজ করছে।
ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য লজিস্টিক সেবা গড়ে তুলে ডাক অধিদপ্তর স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিক বাজারে সংযুক্ত করছে।
২০২৫ সালের বিশ্ব ডাক দিবস উদযাপন
বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ৯–১০ অক্টোবর আয়োজন করেছে দুই দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা জনাব ফরহাদ আহমেদ তৈয়্যব এবং
সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
উদযাপনস্থল: আগারগাঁও ডাক ভবন, যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে—
নতুন স্মারক ডাকটিকিট ও স্মারক খাম উন্মোচন:
ডাক বিভাগের উদ্ভাবনী কার্যক্রম প্রদর্শনী
সেবা গ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা বিনিময় অনুষ্ঠান
ও প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী
বিশেষ আকর্ষণ ও প্রদর্শনীর আয়োজক,
প্রফেসর ডাঃ আব্দুল্লাহ আল শফি মজুমদার বলেন—
নতুন প্রজন্মকে বেশি বেশি চিঠি লেখায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
কারণ চিঠি মানুষের হৃদয়ের ভাষা, যা ডিজিটাল বার্তায় কখনো ধরা পড়ে না।
তিনি ডাক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত স্মারক ডাকটিকিট, খাম ও বিভিন্ন মুদ্রার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ডাক যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে।
এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এই আয়োজনে দেশের শীর্ষ পার্সেল সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ—সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, ড্যাফোডিল পার্সেল সার্ভিস, মাইলেক্সসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের স্টল স্থাপন করে।
প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে সংরক্ষিত, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত মূল্যবান ধাতব মুদ্রা, কাগজের মুদ্রা ও পুরনো স্ট্যাম্প—যা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত বাহক হিসেবে উপস্থিত ছিল দর্শনার্থীদের সামনে।
নতুন স্মারক ডাকটিকিট ও খামের উন্মাদনা:
উন্মোচনের পর থেকেই ডাক ভবনে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
নতুন স্মারক ডাকটিকিট ও খাম সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। এতে অংশগ্রহণ করেছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সংগ্রাহক সহ তরুণ ও যুব সমাজের প্রতিনিধিরা—
তাদের মুখে আনন্দ, হাতে নতুন খাম ও স্ট্যাম্প, হৃদয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের গর্ব।
ডাক বিভাগের বৈশ্বিক গুরুত্ব:
ডাক বিভাগ কেবল বার্তা পৌঁছে দেয় না—
এটি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মানবিক সংযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রবাহের চালিকাশক্তি।
আজও ডাককর্মীরা মানবতার দূত—তারা পৌঁছে দেন তথ্য, সম্পদ ও ভালোবাসা,এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
শেষকথা:
ডিজিটাল যুগেও ডাক বিভাগের প্রাসঙ্গিকতা কমেনি—বরং বেড়েছে নতুন মাত্রায়।
ডাক মানে কেবল যোগাযোগ নয়; এটি আস্থা, দায়িত্ব ও মানবিকতার প্রতীক।
ডাক বিভাগের কর্মীরা প্রতিদিন মানুষের বার্তা, আশা,
স্বপ্ন ও জীবন পৌঁছে দেন
নিরবচ্ছিন্নভাবে—
স্থানীয় সেবা থেকে বৈশ্বিক সংযোগে—জনগণের জন্য ডাক।
ডাক—একটি চিঠির ভেতর বন্দী মানুষের হৃদয়,
এ শুধু ডাক নয়, এটি বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগ।

আরো