তামাক কোম্পানি গুলোর আইন লঙ্ঘন: “তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০” লক্ষ্য হুমকিতে
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে বিদ্যমান কঠোর আইন থাকার পরও তামাক কোম্পানিগুলোর লাগামহীন আইন ভঙ্গের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নতুন পণ্য বাজারে আনার সঙ্গে সঙ্গে দেশের নানা স্থানে গোপনে আয়োজন করা হচ্ছে প্রচারমূলক ইভেন্ট, উপহার বিতরণ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচার। ২০০৫ সালের তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন এবং ২০১৩ সালের সংশোধনী অনুযায়ী এসব কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও, বাস্তবে তা কার্যকরভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে তামাকের প্রতি আকর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা “তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০” লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উক্ত আইনে যা বলা হয়েছে
কোনো তামাকজাত পণ্যের সরাসরি বা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন, প্রচার, ছাড় বা উপহার দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
গণমাধ্যম, দোকান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা যেকোনো ইভেন্টে তামাক ব্র্যান্ড বা লোগো প্রদর্শন দণ্ডনীয় অপরাধ।
তামাক কোম্পানি CSR (Corporate Social Responsibility) কার্যক্রমের আড়ালে তাদের ব্র্যান্ড প্রচার করতে পারবে না।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব নিয়ম প্রায়ই উপেক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন তামাক কোম্পানি “ব্র্যান্ড অ্যাক্টিভেশন”, “লাকি ড্র”, “লাউঞ্জ ইভেন্ট” কিংবা “লাইফস্টাইল ক্যাম্পেইন”-এর নামে তামাক পণ্যকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করছে। এই সব আয়োজনের মূল লক্ষ্য— নতুন প্রজন্মের মাঝে ধূমপান ও অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারকে “স্টাইল” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
গোপন প্রচারণার কৌশল
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তামাক কোম্পানিগুলো বর্তমানে সরাসরি বিজ্ঞাপন না করে ‘গোপন মার্কেটিং’ কৌশলে কাজ করছে। যেমন— দোকানের কাউন্টারে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বিশেষ ডিসপ্লে, অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে ‘লাইফস্টাইল কনটেন্ট’, কিংবা জনপ্রিয় সঙ্গীতানুষ্ঠান ও স্পোর্টস ইভেন্টে ব্র্যান্ডের রঙ বা লোগো ব্যবহার করা। অনেক সময় এসব প্রচারণা CSR প্রকল্পের ছদ্মবেশে চালানো হয়, যাতে আইনগতভাবে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি তামাকবিরোধী পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত এক বছরে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ৫০টির বেশি এমন গোপন প্রচারণার ঘটনা চিহ্নিত করা গেছে, যার বেশিরভাগই তরুণ ও নতুন ভোক্তাদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে।
তরুণ সমাজ বিপদের মুখে
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রচারণা কৌশল সরাসরি তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করছে। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের হার গত পাঁচ বছরে প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামীমা নাসরিন বলেন,
“তামাক কোম্পানিগুলো নতুনভাবে তরুণদের টার্গেট করছে। তারা তামাককে ফ্যাশন হিসেবে দেখাতে চাইছে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি
দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আইন বাস্তবায়নে শিথিলতার বিরুদ্ধে সরব। তাদের অভিযোগ, মাঠ পর্যায়ে কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে কোম্পানিগুলো আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করছে।
PROGGA-এর নির্বাহী পরিচালক হাসান মেহেদী বলেন,
“তামাক আইন ভঙ্গের জন্য জরিমানার পরিমাণ বর্তমানে খুবই সামান্য। কোম্পানিগুলো সহজেই জরিমানা দিয়ে আবারও একই কাজ করে। তাই জরিমানার হার বাড়াতে হবে এবং বারবার আইন ভঙ্গ করলে লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।”
সরকারের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও মানবসম্পদ ও বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে তা পর্যাপ্ত নয়। একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ পরিদর্শক সংখ্যা খুবই সীমিত— যা সারাদেশে তদারকির জন্য অপ্রতুল।
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর মতে, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়হীনতার কারণেও আইন প্রয়োগে শিথিলতা দেখা যায়। এছাড়া অনেক সময় তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব ও কর রাজস্বের অজুহাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. খালিদ হোসেন বলেন,
“তামাক কোম্পানির প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ না হলে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাবে। এটি শুধু জনস্বাস্থ্যের নয়, অর্থনীতির জন্যও ভয়াবহ।”
সরকার ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিল, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেই লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
PROGGA, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ আন্দোলন, ধূমপানবিরোধী যুব সংগঠনসহ একাধিক সংগঠন বলছে,
যদি এখনই আইন প্রয়োগ ও মনিটরিং জোরদার না করা হয়, তবে “তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০” কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
সমাধানের প্রস্তাব
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে—
আইন ভঙ্গের জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি ও পুনরাবৃত্ত অপরাধে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল।
স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং টিম গঠন করে নিয়মিত অভিযানে নামা।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তামাক প্রচারণা নিয়ন্ত্রণে সাইবার মনিটরিং সেল গঠন।
CSR কার্যক্রমের নামে তামাক কোম্পানির প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
তামাক কর ও প্যাকেট সতর্কবার্তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।
তামাকের বিরুদ্ধে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই— এমন বাস্তবতায় দেশের জনস্বাস্থ্য ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে তামাকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে হলে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি মাঠ পর্যায়ে বাস্তব প্রয়োগে মনোযোগ না দেন, তাহলে “তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০” শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হয়েই থেকে যাবে।