রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ

বুড়িগঙ্গার বুকে খেয়া নৌকার টিকে থাকার সংগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী শুধু একটি জলধারা নয়, বরং এই নগরের জীবনরেখা। একসময় এ নদীর জল বর্ষার পর স্বচ্ছ ও নির্মল থাকত, নদীর বুকে ভেসে চলা ডিঙি নৌকা হয়ে উঠত নগরবাসীর যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র ভরসা। কিন্তু আজ সেই নদী দূষিত, দুর্গন্ধময়; তবুও থেমে নেই মাঝিদের জীবন ও জীবিকার লড়াই।

ইতিহাসের শেকড়:

ব্রিটিশ আমল থেকে সোয়ারীঘাট ঢাকার অন্যতম ব্যস্ততম নৌপথ। পুরান ঢাকা ও জিনজিরার মানুষের সংযোগ রক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল খেয়া নৌকা। ব্যবসা, পণ্য পরিবহন কিংবা সাধারণ যাতায়াত—সবই নির্ভর করত এই নৌকার ওপর। এক সময় মাঝিরাই ছিলেন ঢাকার ট্যাক্সি চালক; তাদের ছাড়া নগরের জীবন থমকে যেত।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক:

আজও প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি সোয়ারীঘাটে ভিড় জমায় শত শত নৌকা। মাঝিদের সুরেলা ডাক—
জিনজিরা-জিনজির সোয়ারীঘাট-সোয়ারীঘাট এই আহ্বান শুধু যাত্রী টানার শব্দ নয়, বরং শতবর্ষের এক অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। সারিবদ্ধ কাঠের নৌকাগুলো যেন শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

মাঝিদের জীবনসংগ্রাম:

মাঝিদের সুখ-দুঃখের হিসাব করলে দুঃখই বেশি। দিনের পর দিন নদীর স্রোতের সঙ্গে লড়াই, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে যাত্রী পারাপার করাই তাদের নিত্যদিনের কাজ। আয় কম, খরচ বেশি। অনেক সময় যাত্রী না পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালি নৌকায় বসে থাকতে হয়। রাতে ক্লান্ত মাঝিরা আবার অনেকেই নৌকার ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েন। জীবন ও জীবিকার টানে তারা এই পেশা আঁকড়ে ধরলেও সন্তানদের আর এই কষ্টের পেশায় আনতে চান না।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নদী দূষণ:

বর্ষার সময় বুড়িগঙ্গার পানি স্বচ্ছ ও সুন্দর থাকলেও বর্ষা শেষে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন, কলকারখানার বর্জ্য ও ট্যানারির বিষাক্ত তরল মিশে নদীকে করে তুলছে কালো ও দুর্গন্ধময়। এর ফলে খেয়া পারাপারের সময় মাঝি ও যাত্রী উভয়কেই নাক চেপে থাকতে হয়, ব্যাগ বা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকতে হয়। দূষিত পানির প্রভাবে দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তবুও খেয়া থেমে নেই—কারণ এ নদীই মাঝিদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

আনন্দ ও মিলনমেলা:

দুঃখের ভিড়েও মাঝিদের জীবনে আনন্দ আসে উৎসবের সময়ে। ঈদ বা দুর্গাপূজার সময় যাত্রী বেশি হলে আয়ও বাড়ে। ঘাটে তখন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মাঝি তখনো ভাটিয়ালি গান গেয়ে নদী কাঁপান। গান শুধু শিল্প নয়, তা তাদের মানসিক প্রশান্তির উৎসও।

সংকট ও ভবিষ্যৎ :

আজ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, লঞ্চ ও আধুনিক সেতুর ভিড়ে ডিঙি নৌকার প্রয়োজনীয়তা কমছে। তরুণ প্রজন্ম আর এই পেশায় আসতে চাইছে না। ফলে শত বছরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নিরাপত্তায় নৌ পুলিশ ও থানা পুলিশের ভূমিকা:
খেয়া নৌকার যাত্রীদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় সমানভাবে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নদীতে নৌ পুলিশ দিনরাত নিরলসভাবে যাত্রী পারাপারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি ডাঙ্গায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ কর্মকর্তারাও যাত্রী ও মাঝিদের সুরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সর্বদা সচেষ্ট রয়েছেন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ পুলিশের নৌ পুলিশ ও থানা পুলিশের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় এবং যাত্রী ও মাঝিদের জন্য ভরসার প্রতীক।

সোয়ারীঘাটের মাঝিরা কেবল শ্রমজীবী নন—তারা ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষ্য। তাদের গল্প, তাদের গান, তাদের সংগ্রাম এক অমূল্য ঐতিহ্য। প্রশ্ন হলো—আমরা কি এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে পারব, নাকি আধুনিকতার চাপে একদিন শুধু গল্পেই শুনতে হবে সোয়ারীঘাটের মাঝিদের কথা?

বুড়িগঙ্গার ঢেউ যেমন থেমে থাকে না, তেমনি থেমে নেই মাঝিদের জীবনসংগ্রামও। রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব এই ইতিহাসকে শুধু স্মৃতিতে নয়, বাস্তবেও টিকিয়ে রাখা। নইলে একদিন ইতিহাস হারাবে, বেঁচে থাকবে কেবল হাহাকার।

আরো