বাল্যবিবাহ বন্ধে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা জোরদার করার উদ্যোগ
বিডি মেইল অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের প্রতিটি দুইজন মেয়ের মধ্যে একজনকে (৫১%) এখনও বাল্য বিবাহের শিকার হতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, সরকার বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে তাদের প্রচেষ্টা জোরদার করছে। বর্তমানে বছরে মাত্র ২% হারে কমার এই ধীর গতিতে চলতে থাকলে এই প্রথা বন্ধ করতে দুই শতাব্দী সময় লেগে যাবে। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছে।বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের লক্ষ্যে আজ একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে।
এই সংলাপের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, এবং এর সহায়তা করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA)। এতে শিক্ষা, আইন ও বিচার, সমাজকল্যাণ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সিনিয়র কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেছেন, তথ্য ও অঙ্গীকারকে বাস্তব কর্মে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এর সহায়তায় এই সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষা, আইন ও বিচার, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। এই সংলাপে উপাত্ত এবং প্রতিশ্রুতিসমূহকে বাস্তব কর্মপরিকল্পনায় রূপ দেওয়ার জন্য আলোচনা করা হয়।
“আমরা যে ত্বরান্বিত অগ্রগতি চাই, তা তখনই অর্জিত হবে যখন এই পদক্ষেপগুলো একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা হবে, এবং এমন একটি সুরক্ষা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে যাতে সকল মেয়েরাই অন্তর্ভুক্ত থাকে, কেও যেন বাদ না যায়,” বলেছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রতিনিধি, মিস ক্যাথরিন ব্রিন কামকং। “যদি একটি মেয়ের আইনি সুরক্ষা, সঠিক জীবন দক্ষতা এবং সুযোগের অভাব থাকে, তবে তাকে স্কুলে রাখা হলেও সে ঝুঁকিতে থাকে। একইভাবে, বাস্তবায়ন ব্যর্থ হলে একটি শক্তিশালী আইনের কোনো অর্থ থাকে না। এই কারণেই আজকের এই বৈঠকটি কার্যত একটি প্রকৃত সর্ব-সরকারীয় পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে।”
এ সংলাপে, মন্ত্রণালয়গুলো একটি প্রমাণভিত্তিক, সময়সীমা নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনায় ঐকমত্য পোষণ করেছে, যার সম্মিলিত লক্ষ্য হলো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে প্রতিটি মেয়ে জোরপূর্বক অবস্থ্রা থেকে মুক্ত হয়ে বড় হতে পারে এবং তার ভবিষ্যতের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
এ বিষয়ে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় বয়সের তথ্য জালিয়াতি প্রতিরোধে বিবাহ নিবন্ধন সিস্টেম ডিজিটালাইজ করতে এবং এবং আইনি ফাঁকফোকর বন্ধ করার জন্য বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সংশোধন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় অঙ্গীকার করেছে যে, তারা স্কুলে ছাত্রীদের শিক্ষা চালূ রাখার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন দক্ষতা শিক্ষা প্রদানের ওপর জোর দেবে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সংক্রান্ত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একই সাথে, বিদ্যালয়গুলোকে মেয়েদের জন্য আরও নিরাপদ করে তোলা হবে এবং শিক্ষাকে “বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষেধক” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কিশোর-কিশোরীদের উচ্চ গর্ভধারণের হার কমানোর লক্ষ্যে জাতীয় সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামোর মধ্যে ব্যাপক ও অধিকার-ভিত্তিক প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়াও, বিবাহিত কিশোরী মেয়েদের এবং প্রথমবারের মতো মা-বাবা হওয়া তরুণ-তরুণীদের জন্য একটি বিশেষায়িত পরিষেবা প্যাকেজ চালু করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নিশ্চিত করবে যে জাতীয় নীতিমালা জেলা পর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, জেলা কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ কার্যকারিতা-ভিত্তিক তহবিল এবং শক্তিশালী জবাবদিহিতার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার কর্মীদের ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্তয়ারপ করেছে। একই সাথে, তৃণমূল পর্যায়ে বাল্যবিবাহ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার জন্য নির্ভরযোগ্য বয়স যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সার্বজনীন জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধনকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ এবং তথ্য মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক কারণ এবং ক্ষতিকর জেন্ডার-ভিত্তিক সামাজিক মানদণ্ড মোকাবিলা করবে, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এবং হৎ পরিসরে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের উদ্যোগ উভয়ই ব্যবহার করবে, যাতে মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন আসে।
“নারী ও মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করলেও, বাল্যবিবাহ একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এটি একটি মেয়ের শৈশব কেড়ে নেয়, তার শিক্ষাজীবন সংক্ষিপ্ত করে দেয় এবং গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, যার ফলস্বরূপ আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়,” বললেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বেগম মমতাজ আহমেদ এনডিসি। “বাংলাদেশ সরকার বহুমাত্রিক ও সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
সমন্বিত কর্মসূচির এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি শেষ হয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে। গৃহীত সমন্বিত কর্মপরিকল্পনাটি পরবর্তী অনুমোদনের জন্য এবং কার্যকরের উদ্দেশ্যে আসন্ন জাতীয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য সম্মতি দেওয়া হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল যৌথভাবে এই কর্মসূচির বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকারগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে, অতিথিরা “সম্ভাবনার ফ্রেম” শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন, যেখানে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েদের জীবন ও স্বপ্ন স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। সহনশীলতা ও আশার ছবি এবং গল্প নিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনীটি নীতিগত আলোচনাকে বাস্তব মানবিক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ থেকে সুরক্ষা, এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানটি যৌথ অঙ্গীকারের এক শক্তিশালী বার্তা দিয়ে সমাপ্ত হয়। মিসেস ব্রিন কামকং উপসংহারে বলেন, “আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। এবং এখন, আমাদের কাজ করার সম্মিলিত সদিচ্ছাও আছে। একসাথে, আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে প্রতিটি মেয়ের শৈশব সুরক্ষিত থাকবে, তার সিদ্ধান্তগুলো সম্মানিত হবে এবং তার সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হবে।”