শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক শিক্ষার অবনতি ও আমাদের ভবিষ্যৎ

আবিদ তাসনিম বর্ষা

একটি জাতির উন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো মানসম্মত শিক্ষা, আর সেই শিক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শুধু একটি শিশুর শিক্ষাজীবনের সূচনা নয়—এটি তার চিন্তা, চরিত্র, নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ জীবনের দিকনির্দেশনা গড়ে দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজকের বাস্তবতায় আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নগামী হচ্ছে।
এক সময় গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সমাজের শ্রদ্ধেয় মানুষ। তিনি শুধু পড়াতেন না, শিশুর চরিত্র গঠনে অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। কিন্তু এখন অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট, ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতি, প্রশিক্ষণের অভাব এবং আধুনিক পাঠদানের ঘাটতি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে শিশুরা বইয়ের জ্ঞান পায় বটে, কিন্তু শেখার আনন্দ, নৈতিকতা ও সৃজনশীল চিন্তার চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
আজকের শিশুরা প্রযুক্তির যুগে জন্ম নিয়েছে। তাদের শেখানোর ধরনও তাই হতে হবে সময়োপযোগী। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো পুরনো পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়, যেখানে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নই প্রধান। ফলে শিশুরা বাস্তব জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তাদের শেখানো হয় কীভাবে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হয়, কিন্তু শেখানো হয় না কিভাবে চিন্তা করতে হয়, প্রশ্ন করতে হয় কিংবা সমস্যা সমাধান করতে হয়।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—বহু বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষাসামগ্রী, প্রযুক্তি, এমনকি মানসম্মত শিক্ষকও নেই। অনেক শিক্ষককে একাধিক শ্রেণি একসাথে নিতে হয়, যা শিক্ষার মান নষ্ট করে দিচ্ছে। এতে করে একজন শিশু তার প্রাথমিক জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ। কারণ যদি ভিত্তি দুর্বল হয়, তবে পরবর্তী সব শিক্ষার কাঠামোই ভেঙে পড়ে।
এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আমরা এমন একটি প্রজন্ম পাব যারা পরীক্ষায় পাস করবে, কিন্তু বাস্তব জীবনের সমস্যা মোকাবিলায় অক্ষম হবে। তারা নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং সমাজের প্রতি সচেতনতা থেকে দূরে সরে যাবে। এভাবেই একটি জাতি তার মানবসম্পদ হারায়, আর উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত হয়।
এখনই সময় প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনার। শুধু স্কুল ভবন নির্মাণ বা বই বিতরণ নয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মানসম্পন্ন পাঠ্যসূচি, প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাসরুম ও শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুদের এমনভাবে শেখাতে হবে যেন তারা জ্ঞানের পাশাপাশি নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও সৃজনশীলতায় বেড়ে ওঠে।
আমরা যদি চাই একটি আলোকিত বাংলাদেশ, তাহলে তার ভিত্তি রচনা করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা শুধু একটি শিশুর নয়, একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার প্রথম ইট।

লেখক
আবিদ তাসনিম বর্ষা
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা।

আরো