শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫, ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির দ্বিমুখী প্রভাব : আমাদের বন্দিত্ব নাকি মুক্তি?

রাইসা রহমান

বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা সারা বিশ্বে তথাকথিত বহুল আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই তথ্যপ্রযুক্তি কি আসলেই আমাদের জন্য অভিশাপ, নাকি এর পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে কোনো অপার মোহময় সম্ভাবনা? চলুন, জেনে নেওয়া যাক :

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা কে পরাধীন করে তুলেছে। কেননা, বর্তমানে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আমরা যতটা যুক্ত, বাস্তবিক জীবনে যেন ঠিক ততটাই বিচ্ছিন্ন। সামাজিক বন্ধন যেন আজ প্রযুক্তির ছায়ায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা আজ মোবাইল গেমস ও সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে মগ্ন হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। তথ্যের অপব্যবহার, সাইবার ক্রাইম, মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচার, গোপনীয়তা লঙ্ঘন ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির কিছু ভয়ঙ্কর ও অভিশপ্ত দিক। শুধু তাই নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত গতিশীলতা কর্মসংস্থানেও এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। অটোমেশন ও রোবোটিক প্রযুক্তি মানুষের শ্রমশক্তিকে প্রতিস্থাপন করেছে, যার ফলে শ্রমজীবী শ্রেণি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রযুক্তি যেন এক বিশাল আগ্রাসী দৈত্য, যা কিনা নিঃশব্দে গ্রাস করে চলেছে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য…।

তবে এর অপর পৃষ্ঠটিও কিন্তু কম গভীর নয়। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়ন বিশ্বে আনয়ন করেছে এক বিপুল পরিবর্তনের স্রোত। একবিংশ শতাব্দীর প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আজ যে শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয়, তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি। ইন্টারনেট, মোবাইল প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডেটা কিংবা অটোমেশন – সবকিছু মিলিয়ে আজ আমরা এমন এক প্রযুক্তিনির্ভর জগতে বাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়ত তথ্যের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রযুক্তির কল্যাণে পুরো পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। আজ কয়েক সেকেন্ডে পৌঁছে যাওয়া যায় বিশ্বের যেকোন প্রান্তে শুধুমাত্র এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই। প্রযুক্তির কল্যাণে কর্মক্ষেত্রে এসেছে স্বচ্ছতা, শিক্ষা হয়েছে বহুমাত্রিক, চিকিৎসা খুৃঁজে পেয়েছে অভিনব পদ্ধতি। প্রযুক্তির কল্যাণে শুধুমাত্র একটি স্মার্টফোন দিয়েই আজ ব্যাংকিং, কেনাকাটা, ভিডিও কল, অনলাইন কোর্স – সবকিছু সম্পন্ন করা যায়। কল্পনাতীত এই সহজতর ব্যবস্থাপনাই আধুনিক প্রযুক্তিকে মানব সভ্যতার এক অসীম দোড়গোঁড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন আজ এই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে মানুষের মনে এত চিন্তার ছাপ? এক নজরে দেখে আসা যাক :

প্রযুক্তি করুণা, নাকি বিস্ময়

প্রযুক্তির অবদানে আজ যখন মাত্র এক ক্লিকেই হাজার মাইল দূরের মানুষও পাশে এসে দাঁড়ায়, তখনই উপলব্ধি করা যায় যে, প্রযুক্তি নিছকই এক উদ্ভাবন নয়, বরং এটি মানব জাতির ভাগ্য পুনর্লিখনের একটি যন্ত্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ইত্যাদি সকল খাতেই প্রযুক্তি যেন এক আলোক রশ্মির ছোঁয়া হয়ে জেগে উঠেছে।

স্ক্রিনের আলোয় ঢেকে যাওয়া বাস্তবতা :

যেখানে চোখ আটকে থাকে স্ক্রিনে সেখানে হৃদয়ের সংযোগ আর কতটা জীবন্ত থাকে? ভার্চুয়াল নেশা আজ বাস্তব বন্ধনকেই করে তুলেছে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজতর করলেও, জীবনবোধকে করে তুলেছে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ।

প্রগতির নামে পিছু হটা :

যেখানে প্রযুক্তি ছিল এক অনন্য মাত্রার অগ্রগতির প্রতীক, সেখানে তা আজ অনেকের জন্য হয়ে উঠেছে কর্মশূন্যতার কারণ। যন্ত্রের দখলে ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের শ্রম, দক্ষতা আর সামাজিক নিরাপত্তা। উন্নতির নামে যেন মানবিকতা পিছু হটছে এক অলক্ষ্য গন্তব্যে…

নিয়ন্ত্রণ কার হাতে – মানুষ না যন্ত্র?

প্রযুক্তি আমাদের গতি দিয়েছে। কিন্তু আমরা কি এখনও এর লাগামধারী? সাইবার অপরাধ, গোপনীয়তার লঙ্ঘন আর তথ্যদূষণ – এসব নিয়ে তো রীতিমত প্রশ্ন উঠছে যে – “আমরা কি প্রযুক্তি চালাচ্ছি, নাকি প্রযুক্তিই আমাদেরকে চালাচ্ছে?”

বিভ্রান্তির মাঝেও দায়িত্বের আলোকছটা :

অন্ধকার আর আলোর দ্বন্দ্বে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আমাদের ব্যবহার, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দক্ষতার নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের। কেননা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করলেও, এর মূল চাবিটা এখনও আমাদের হাতেই রয়েছে।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এক বিরাট সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না হলে এই সম্ভাবনাই পরিণত হতে পারে মানবজাতির এক সুপরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞে। প্রযুক্তির গতি ও মানবিকতার ভারসাম্য রক্ষা করে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি, তবে এই প্রযুক্তিই হবে এক অনন্য আশীর্বাদ। আর তা না হলে এই আশীর্বাদই হয়ে উঠবে এক নীরব ও নীরবধি অভিশাপ। কারণ, প্রযুক্তি একটি নিরপেক্ষ শক্তি, যাকে মানুষ তার চাহিদা ও মানসিকতার প্রতিফলন অনুযায়ী রূপ দেয়। সুতরাং আমাদের ব্যবহারই প্রযুক্তির ভাগ্য নির্ধারণ করে। তাই প্রশ্নটা এখন আর “প্রযুক্তি অভিশাপ, নাকি আশীর্বাদ” – এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর সঠিক জবাব নিহিত রয়েছে আমাদের প্রযুক্তিকে বেছে নেওয়ার পদ্ধতিতে।

বর্তমান সময়ের দ্বিমুখী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রযুক্তিকে কেবল ‘আশীর্বাদ’ বা ‘অভিশাপ’ হিসেবে একপাক্ষিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। বরং এটি একটি দ্বৈত-বাস্তবতা। এর ব্যবহারের উপরই নির্ভর করে এর ইতিবাচকতা অথবা নেতিবাচকতা। উদাহরণস্বরূপ: আগুন যেমন রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়, আবার তা দাহের জন্যও ব্যবহৃত হয়। ঠিক তেমনিভাবে প্রযুক্তিও উপকারী কিংবা সর্বনাশী হতে পারে, এটা নির্ভর করে তার ব্যবহারের মাত্রা ও উদ্দেশ্যের উপর।

লেখিকা
রাইসা রহমান
মীরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা

আরো