সংশয় কেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না!
অরুণ কর্মকার
নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে সে বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ওঠা কতিপয় বাস্তব অভিযোগ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রকাশ্য অভিযোগ ও তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৫ জন হাই প্রোফাইল প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এই সংশয় যথেষ্ট বাস্তব হয়ে উঠেছে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কি সন্দেহ-সংশয় আছে? আপাতদৃষ্টিতে নেই। নির্বাচন ওই সময়েই হবে— সাধারণভাবে এমনটাই ধারণা করা যায়। সরকারের ঘোষণা ও নানা সময়ের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি—এসবই এই ধারণার ভিত্তি। তারপরও কি কোথাও কোনো সংশয় নেই! আছে। বৃহত্তর জনপরিসরে তো আছেই, এমনকি রাজনৈতিক মহলও পুরোপুরি নিঃসংশয় নয়। যে কারণে কোনো ফাঁকফোকর দেখলেই তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে কথার পিঠে কথা প্রসঙ্গে সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে বললেন, ‘দেশে এমন মানুষও আছেন যাঁরা বলছেন পাঁচ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন।’ সেই কথা ধরেই বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বললেন, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আসলে কী বলতে চাইছেন, সেটিই এখন প্রশ্ন। তিনি এই কথা বলে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা খুব দক্ষ ও সূক্ষ্ম ছিদ্রান্বেষীও। তাঁরা প্রথমত রাজনীতিকদের ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি অভিনিবেশসহকারে পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা করেন। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টার মতো সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি যদি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেটাকে তাঁরা ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চিত নির্দেশনা বলে মনে করেন না। কারণ, ওই কথার মধ্যে এই ইঙ্গিতও সুপ্ত থাকে যে যথেষ্ট প্রস্তুতি না হলে ওই সময় নির্বাচন না-ও হতে পারে। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাই বলেছিলেন। সে কথা ছিদ্রান্বেষীদের ব্যাখ্যার ভিন্ন অর্থও বোঝাতে পারে। কিন্তু এসবের পেছনে মোদ্দা কথা হলো সংশয়। সংশয় এমন একটি বিষয়, যা নিরেট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া দূর করা যায় না।
এই যে ব্যাপক বিস্তৃত সংশয়, এর গূঢ় কারণ কী? কারণ বোধ হয় আওয়ামী লীগ। আসলে বলা ভালো আওয়ামী লীগের জুজু। কারণ, আওয়ামী লীগ তো কার্যত নেই। অথচ সর্বত্র শঙ্কা—আওয়ামী লীগ যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন ভন্ডুল করে দিতে পারে ইত্যাদি। আওয়ামী লীগকে তাড়িয়েও এই যে ভয়, তার কারণ বোধ হয় আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে আমরা যা করতে চেয়েছিলাম, নতুন বন্দোবস্ত, দায় ও দরদের সমাজ, জনগণের ক্ষমতায়ন—এসবের ধারেকাছেও আমরা যেতে পারিনি। বরং প্রায় সব কর্মে পুরোনোরই পুনরাবৃত্তি হয়েছে, হচ্ছে। ফলে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার ফাঁকও রয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘…তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে বাইরের কিছু শক্তি তাঁকে (শেখ হাসিনাকে যার বিস্তৃত অর্থ আওয়ামী লীগকে) বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সব সময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ ব্যবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে এই জুজুর ভয় থেকে আমাদের রক্ষা হবে কীভাবে! কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে কিংবা আদালতের রায়ে দল নিষিদ্ধ করে কি এই ভয় থেকে প্রকৃতই মুক্তি পাওয়া যাবে?
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যেমন এসব সন্দেহ-সংশয় রয়েছে, তেমনি নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ওঠা কতিপয় বাস্তব অভিযোগ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রকাশ্য অভিযোগ ও তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৫ জন হাই প্রোফাইল প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এই সংশয় যথেষ্ট বাস্তব হয়ে উঠেছে। ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার নীলক্ষেতে ছাপার বিষয়টি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ছাত্রসংগঠনগুলো এখন ভোটার তালিকা দেখে নিশ্চিত হতে চাইছে যে প্রকৃতপক্ষে কত শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে এখনো চুপচাপ। এ নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভও করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে যতই বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টিকারী হবে বলে বলা হোক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন হবে। অবশ্য বলা হতে পারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠান তো সরকারের দায়িত্ব নয়, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু একাধিক নির্বাচন কমিশনারও ইতিমধ্যে একাধিকবার বলেছেন যে আগামী নির্বাচন আয়োজন ও অনুষ্ঠান করা হবে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ আরও কিছু আছে। জামায়াতসহ সমমনা কয়েকটি দলের পাঁচ দফা দাবিভিত্তিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি; ওই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান; সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতির নির্বাচন এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ এই পাঁচ দফা দাবিতে তারা শেষ পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা করেছে। জামায়াতের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। হয়তো তারা এ বিষয়ে কোনো জরিপ করেছে। যার ভিত্তিতে শতাংশ উল্লেখ করে বলতে পারছে। ১৫ অক্টোবর চূড়ান্ত জুলাই সনদ পাওয়া যাবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঘোষণা করেছে। সেই সনদ যে যথেষ্ট কাটাছেঁড়া করে আপসরফার একটি সনদ হতে যাচ্ছে, তা এখন স্পষ্ট। কাজেই সেই সনদ কীভাবে সবাই গ্রহণ করেন, সেটাও এখন পর্যন্ত দেখার বিষয় হয়েই আছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান দাবি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন। শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রথমে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিই দলটি তুলেছিল। পরে সেখান থেকে কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করা হলেও মেনে নেবে বলে ঘোষণা করেছে। তবে এনসিপি কোনোভাবেই গণপরিষদ নির্বাচন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি থেকে সরে যায়নি। এ ছাড়া এখন তাদের একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনী প্রতীক। নির্বাচন কমিশন তাদের কাঙ্ক্ষিত শাপলা যে বরাদ্দ করবে না, তা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে এবং অন্য কোনো প্রতীক বাছাই করে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এনসিপি এখনো শাপলা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থানে আছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার কথাও দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। উল্লিখিত যেকোনো একটি বা একাধিক উপাদান নির্বাচন হতে না দেওয়া কিংবা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য করা অথবা নির্বাচন আয়োজনে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট নয় কি! তারপরও আমরা বিশ্বাস করি নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে, যার মাধ্যমে দেশে অবাধ গণতন্ত্রের পথযাত্রা শুরু হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক